দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে ট্রেন চলাচলের মধ্যদিয়ে খুলছে অপার সম্ভাবনার দুয়ার। এক সময় কক্সবাজারবাসীর কাছে যা ছিল স্বপ্ন, তা এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত বাণিজ্যের নতুন দুয়ার খুলে দিচ্ছে কক্সবাজারের ট্রান্স এশিয়ান রেলপথ। আগামীতে বাংলাদেশের ঘুমধুম থেকে মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং পৌঁছাবে তুরস্ক থেকে আসা ট্রান্স-এশিয়ান আন্তর্জাতিক রেল সংযোগ। এতে শুধু পর্যটন শিল্পেরই বিকাশ নয়, শিল্পকারখানা স্থাপনেও রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
বিশ্বের অন্যতম টানা দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতের অবস্থান কক্সবাজার হলেও স্বাধীনতার ৫০ বছরেও গড়ে ওঠেনি কোন ধরনের শিল্প কারখানা। নামেমাত্র রয়েছে কিছু লবণ মিল ও চিংড়ি মাছের প্রজনন কেন্দ্র। তবে শিল্প বিকাশে এবার সম্ভাবনার আলো দেখাচ্ছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ। এর মধ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনা।
সব কর্মকাণ্ড শেষ করে কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশন এখন প্রস্তুত ঐতিহাসিক রেলযাত্রার জন্য। শনিবার (১১ নভেম্বর) আনুষ্ঠানিকভাবে কক্সবাজার রেলপথ এবং আইকনিক স্টেশন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার পৌঁছানোর পর বেলা ১১টায় যাবেন কক্সবাজারের ঝিলংজার আইকনিক রেলস্টেশনে। যেখানে এক সুধী সমাবেশ শেষে উদ্বোধন করবেন রেললাইন। আইকনিক রেলস্টেশনে টিকিট কেটে ট্রেনে করে ঘুরে দেখবেন রেললাইনের কিছু অংশ। এরপর তিনি যাবেন মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে, যেখানে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক জনসভায় ভাষণ দেবেন তিনি। জনসভা শেষে তিনি ঢাকার পথে পাড়ি জমাবেন।
আজ কক্সবাজারে প্রতীকী অর্থে নয়, সত্যিকার অর্থেই রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হচ্ছে আগামীর আলো, সম্ভাবনার আলো। ফলে চারদিকেই উৎসবমুখর পরিবেশ, সাজসাজ রব।
স্বপ্ন ও বাস্তবায়ন যার হাত ধরে
১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার পর্যন্ত মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার এবং রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার।
দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের অদূরে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ২০১০ সালে হাতে নেয় সরকার। প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০.৮৩ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে ৯টি রেলওয়ে স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট ও ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট। আর লেভেল ক্রসিং করা হয়েছে ৯৬টি।
উদ্বোধনের প্রায় সাত বছর পর ২০১৮ সালে ডুয়েল গেজ এবং সিঙ্গেল ট্র্যাক রেললাইন প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রথমে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু কক্সবাজারে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক স্টেশনটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ২১৫ কোটি টাকা।
এতে অর্থায়ন করেছে এশিয়ান ব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকার। এটি সরকারের অগ্রাধিকার (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড পৃথক দুই ভাগে কাজটি করে।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান বলেন, কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন ছিল কক্সবাজারবাসীর শত বছরের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ জন্য শেখ হাসিনার প্রতি কক্সবাজারবাসীর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
কী আছে আইকনিক রেলস্টেশনে
কক্সবাজার সৈকতের কাছে ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দের পাড়ায় নির্মিত হয়েছে ঝিনুক আকৃতির দৃষ্টিনন্দন ছয়তলাবিশিষ্ট আইকনিক রেলস্টেশন। ২৯ একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা ১ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুটের রেলস্টেশনটি উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
নতুন এই রেলস্টেশনে থাকছে তারকা মানের হোটেল, শপিংমল, রেস্তোরাঁ, শিশুযত্ন কেন্দ্র, লাগেজ রাখার লকারসহ অত্যাধুনিক সুবিধা। দৈনিক ৪৬ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আইকনিক রেলস্টেশনে আরও আছে ডাকঘর, কনভেনশন সেন্টার, তথ্যকেন্দ্র, এটিএম বুথ ও প্রার্থনার স্থান।
রেলস্টেশন ও দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প উদ্বোধনের ঐতিহাসিক মুহূর্ত উপভোগ করতে অধীর আগ্রহে আছেন কক্সবাজারবাসী। এই রেললাইন ও স্টেশন তাদের কাছে শত বছরের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। স্থানীয় লোকজন মনে করেন, রেল যোগাযোগ স্থাপনের পর কক্সবাজারের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারসহ পর্যটনের নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটবে।
কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু তাহের চৌধুরী বলেন,
কক্সবাজারে ট্রেন আসবে, এটা মানুষের কল্পনাতেও ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক ইচ্ছায় সেই কল্পনা ও স্বপ্ন দুটোই এখন বাস্তব। রেল চালুর পর কক্সবাজার-চট্টগ্রাম সড়কপথে মানুষের চাপ, দুর্ভোগ ও দুর্ঘটনা কমে আসবে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের কর্মকর্তারা জানান, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছয়তলা ভবনের রেলস্টেশনের সামনে খোলা মাঠে তৈরি হয়েছে ঝিনুক আকৃতির দৃষ্টিনন্দন একটি ফোয়ারা। যাত্রীরা ঝিনুক ফোয়ারা দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করবেন। তারপর চলন্ত সিঁড়ির মাধ্যমে সেতু হয়ে উঠবেন ট্রেনে। আবার ট্রেন থেকে নেমে ভিন্ন পথে বেরিয়ে যাত্রীরা পা বাড়াবেন সমুদ্রসৈকতের দিকে। গমন ও বহির্গমনের জন্য তৈরি হয়েছে পৃথক দুটি সড়ক। আছে গাড়ি পার্কিংয়ের পৃথক তিনটি বড় জায়গা।
ভবনের পূর্ব পাশে নির্মিত হয়েছে ৮০ ফুট লম্বা পদচারী-সেতু। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় পৃথক তিনটি চলন্ত সিঁড়ি। বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। ভবনের উত্তরে ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থের ৩টি প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। মূল ভবনের নিচতলার রাখা হয়েছে টিকিট কাউন্টার, অভ্যর্থনা কক্ষ, লকার, তথ্যকেন্দ্র, মসজিদ, শিশুদের বিনোদনের জায়গা, প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ ও পদচারী-সেতুতে যাতায়াতের পথ। দ্বিতীয় তলায় শপিংমল, শিশুযত্ন কেন্দ্র, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। তৃতীয় তলায় ৩৯ কক্ষবিশিষ্ট তারকা মানের হোটেল, চতুর্থ তলায় রেস্তোরাঁ, শিশুযত্ন কেন্দ্র, কনফারেন্স হল ও কর্মকর্তাদের কার্যালয়।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে আইকনিক এই রেলস্টেশন। ঢাকা থেকে রাতের ট্রেন ধরে সকালে কক্সবাজার নেমে পর্যটকেরা লাগেজ, মালামাল স্টেশনে রেখে সারা দিন সমুদ্রসৈকত বা দর্শনীয় স্থান ঘুরে রাতের ট্রেনে আবার ফিরতে পারবেন নিজ গন্তব্যে। স্টেশন ভবনের পশ্চিম পাশে নির্মাণ করা হয়েছে পাঁচতলা বিশিষ্ট ২০টি ভবন।
সীমান্ত বাণিজ্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ট্রান্স এশিয়ান রেলপথ
বাংলাদেশের সীমান্ত বাণিজ্যের নতুন দুয়ার খুলে দিচ্ছে কক্সবাজারের ট্রান্স এশিয়ান রেলপথ। আপাতত চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে শুরু হয়ে কক্সবাজারে শেষ হবে। আগামীতে বাংলাদেশের ঘুমধুম থেকে মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং পৌঁছাবে তুরস্ক থেকে আসা ট্রান্স-এশিয়ান আন্তর্জাতিক রেল সংযোগ। এতে শুধু পর্যটন শিল্পেরই বিকাশ নয়, শিল্পকারখানা স্থাপনেও রাখবে ভূমিকা।
বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতের অবস্থান কক্সবাজার হলেও স্বাধীনতার ৫০ বছরেও গড়ে ওঠেনি কোনো শিল্প কারখানা। নামেমাত্র রয়েছে কিছু লবণ মিল ও চিংড়ি মাছের প্রজনন কেন্দ্র। তবে, শিল্প বিকাশে এবার আশার আলো দেখাচ্ছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ। এর মধ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনা। ব্যবসায়ীদের আশা, ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হলে বাড়বে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার। আর বিদেশি পর্যটকের নতুন গন্তব্য হবে কক্সবাজার।
কক্সবাজারের হোটেল কক্স টুডের ব্যবস্থাপক আবু তালেব শাহ বলেন, ‘যত দ্রুত এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে, তত দ্রুত এখানকার পর্যটন শিল্প উপকৃত হবে। ঘুরে দাঁড়াবে এ শিল্প এবং এটি জিডিপিকে প্রভাবিত করবে।’
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন,
এ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটবে। সহজ হবে পণ্য আনা-নেয়া। একই সঙ্গে কক্সবাজারে উৎপাদিত লবণ, সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ, টেকনাফ স্থলবন্দরের আমদানি-রফতানির মালামাল পরিবহনে সুবিধা বাড়বে। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের।
২০১০ সালে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নেয়া হয়। তবে ভূরাজনৈতিক জটিলতায় কক্সবাজার থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটারের কাজ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। এই রেলপথ উদ্বোধনের পর নতুন স্বপ্ন আগামীতে বাংলাদেশের ঘুমধুম থেকে মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং পৌঁছাবে তুরস্ক থেকে আসা আন্তর্জাতিক রেল সংযোগ।
কক্সবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে কুনমিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে এ রেললাইন। এতে দেশের রেল ও অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনা তৈরি হবে।’